Polytechnic Course: মাধ্যমিকের পরেই চাকরির সেরা সুযোগ? যোগ্যতা, পরীক্ষা, খরচ, কলেজের নাম সহ বিস্তারিত দেখে নিন!

পলিটেকনিক কোর্স: উজ্জ্বল ভবিষ্যতের সহজ সোপান
Polytechnic Course: আজকের দিনে দ্রুত পরিবর্তনশীল প্রযুক্তি এবং শিল্পের বাজারে কেরিয়ার গড়ার জন্য সঠিক কোর্স বেছে নেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে পলিটেকনিক বা ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং কোর্সগুলি ক্রমশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। মাধ্যমিক বা উচ্চ মাধ্যমিকের পর অপেক্ষাকৃত কম সময়ে প্রযুক্তিগতবিদ্যায় পারদর্শী হয়ে ওঠা এবং দ্রুত কর্মজীবনে প্রবেশের এক নির্ভরযোগ্য পথ হল পলিটেকনিক। এই প্রতিবেদনে আমরা পলিটেকনিক কোর্স সম্পর্কিত খুঁটিনাটি বিষয়গুলি বিস্তারিতভাবে আলোচনা করব।
পলিটেকনিক কোর্স আসলে কী?
পলিটেকনিক হল একটি কারিগরি বা প্রযুক্তিগত ডিপ্লোমা কোর্স। সাধারণত এই কোর্সের মেয়াদ ৩ বছর হয়। তবে, উচ্চ মাধ্যমিক (বিজ্ঞান শাখা) বা আইটিআই (ITI) পাশ করা ছাত্রছাত্রীরা ‘VOCLET’ পরীক্ষার মাধ্যমে সরাসরি দ্বিতীয় বর্ষে ভর্তি হতে পারে, সেক্ষেত্রে কোর্সের মেয়াদ হয় ২ বছর। এই কোর্সের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা ইঞ্জিনিয়ারিং-এর বিভিন্ন শাখার প্রাথমিক এবং ব্যবহারিক জ্ঞানে সমৃদ্ধ হয়, যা তাদের শিল্পক্ষেত্রে কাজ করার জন্য প্রস্তুত করে তোলে।
কারা করতে পারবে এই কোর্স? (যোগ্যতা)
পলিটেকনিক কোর্সে ভর্তির জন্য প্রধানত দুটি পথের একটি বেছে নিতে হয়:
- প্রথম বর্ষে ভর্তি (JEXPO পরীক্ষার মাধ্যমে):
- মাধ্যমিক বা সমমানের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হবে।
- গণিত, ভৌতবিজ্ঞান/বিজ্ঞান এবং ইংরেজি বিষয়ে ন্যূনতম ৩৫% নম্বর থাকা আবশ্যিক।
- বয়স: সাধারণত কোনো ঊর্ধ্বসীমা নেই, তবে আবেদনকারীকে নির্দিষ্ট বছরের ১লা জুলাইয়ের আগে জন্মগ্রহণ করতে হবে (যেমন, ২০২৫ সালের পরীক্ষার জন্য প্রার্থীর জন্মতারিখ ০১.০৭.২০০৯ এর পরে হওয়া চলবে না)।
- আবেদনকারীকে ভারতীয় নাগরিক হতে হবে।
- দ্বিতীয় বর্ষে সরাসরি ভর্তি বা ল্যাটারাল এন্ট্রি (VOCLET পরীক্ষার মাধ্যমে):
- উচ্চ মাধ্যমিক (১০+২) বিজ্ঞান শাখায় (পদার্থবিদ্যা, রসায়ন ও গণিত সহ) উত্তীর্ণ হতে হবে। অথবা,
- উচ্চ মাধ্যমিক (১০+২) ভোকেশনাল শাখায় উত্তীর্ণ হতে হবে। অথবা,
- মাধ্যমিক পাশের পর ২ বছরের আইটিআই (ITI) কোর্স সম্পূর্ণ করতে হবে।
- বয়স: এক্ষেত্রেও সাধারণত কোনো ঊর্ধ্বসীমা নেই।
ভর্তি প্রক্রিয়া কেমন হয়?
পশ্চিমবঙ্গে পলিটেকনিক কোর্সে ভর্তি মূলত দুটি প্রবেশিকা পরীক্ষার মাধ্যমে হয় – JEXPO (জয়েন্ট এন্ট্রান্স একজামিনেশন ফর পলিটেকনিক্স) এবং VOCLET (ভোকেশনাল ল্যাটারাল এন্ট্রি টেস্ট)। এই পরীক্ষাগুলি পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা এবং দক্ষতা উন্নয়ন সংসদ (West Bengal State Council of Technical and Vocational Education and Skill Development – WBSCVT&VE&SD) দ্বারা পরিচালিত হয়।
- JEXPO: মাধ্যমিক পাশ করা ছাত্রছাত্রীরা প্রথম বর্ষে ভর্তির জন্য এই পরীক্ষা দেয়।
- VOCLET: উচ্চ মাধ্যমিক (বিজ্ঞান/ভোকেশনাল) বা আইটিআই পাশ করা ছাত্রছাত্রীরা দ্বিতীয় বর্ষে (ল্যাটারাল এন্ট্রি) ভর্তির জন্য এই পরীক্ষা দেয়।
উভয় পরীক্ষাতেই প্রাপ্ত র্যাঙ্কের ভিত্তিতে অনলাইন কাউন্সেলিং-এর মাধ্যমে বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি পলিটেকনিক কলেজে ভর্তির সুযোগ পাওয়া যায়।
কী কী বিষয় নিয়ে পড়া যায়? (জনপ্রিয় শাখা)
পলিটেকনিকে বিভিন্ন ইঞ্জিনিয়ারিং ও টেকনোলজি শাখায় ডিপ্লোমা করার সুযোগ রয়েছে। এদের মধ্যে কয়েকটি জনপ্রিয় শাখা হল:
- সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং
- মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং
- ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং
- কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি
- ইলেকট্রনিক্স অ্যান্ড টেলিকমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং
- অটোমোবাইল ইঞ্জিনিয়ারিং
- আর্কিটেকচার
- কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং
- মেটালার্জিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং
- সার্ভে ইঞ্জিনিয়ারিং
- ইন্সট্রুমেন্টেশন টেকনোলজি
পড়াশোনার খরচ কেমন?
পলিটেকনিক কোর্সের খরচ মূলত নির্ভর করে প্রতিষ্ঠানটি সরকারি না বেসরকারি তার উপর।
- সরকারি পলিটেকনিক কলেজ: এখানে পড়াশোনার খরচ খুবই কম। বার্ষিক টিউশন ফি এবং অন্যান্য খরচ মিলিয়ে বছরে আনুমানিক ১,৮০০ থেকে ৩,০০০ টাকার মধ্যে থাকে।
- বেসরকারি পলিটেকনিক কলেজ: এই কলেজগুলিতে খরচ তুলনামূলকভাবে বেশ অনেকটাই বেশি। সম্পূর্ণ তিন বছরের কোর্স ফি সাধারণত ৫০,০০০ টাকা থেকে শুরু করে ২,০০,০০০ টাকা বা তার বেশিও হতে পারে, যা কলেজ ও তার পরিকাঠামোর উপর নির্ভরশীল। তাই ভর্তির আগে নির্দিষ্ট কলেজের ফি কাঠামো ভালোভাবে জেনে নেওয়া উচিত।
পলিটেকনিক পাশের পর ভবিষ্যৎ কী?
পলিটেকনিক ডিপ্লোমা করার পর ছাত্রছাত্রীদের সামনে একাধিক সম্ভাবনার দ্বার খুলে যায়:
- চাকরি:
- সরকারি ক্ষেত্রে: রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে (যেমন PWD, রেল, ডিফেন্স, বিদ্যুৎ পর্ষদ) জুনিয়র ইঞ্জিনিয়ার বা সাব-অ্যাসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ার পদে চাকরির সুযোগ থাকে।
- বেসরকারি ক্ষেত্রে: বিভিন্ন বেসরকারি নির্মাণ সংস্থা, উৎপাদন শিল্প, আইটি কোম্পানি এবং টেলিকম সংস্থায় আকর্ষণীয় পদে কাজ পাওয়া যায়। ক্যাম্পাস প্লেসমেন্টের মাধ্যমেও বহু ছাত্রছাত্রী কোর্স শেষের আগেই চাকরি পেয়ে থাকে।
- শিক্ষকতা: আইটিআই বা ভোকেশনাল প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলিতে প্রশিক্ষক হিসেবেও কাজ করার সুযোগ থাকে।
- উচ্চশিক্ষা:
- ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করার পর ছাত্রছাত্রীরা চাইলে B.Tech বা B.E. ডিগ্রিও করতে পারে। এর জন্য তাদের JELET (জয়েন্ট এন্ট্রান্স ল্যাটারাল এন্ট্রি টেস্ট) পরীক্ষা দিতে হয়। এই পরীক্ষার মাধ্যমে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের দ্বিতীয় বর্ষে সরাসরি ভর্তি হওয়া যায়।
- স্বনির্ভর প্রকল্প/ব্যবসা:
- কারিগরি বিদ্যায় পারদর্শী হওয়ার ফলে অনেকেই নিজস্ব ব্যবসা বা স্বনির্ভর প্রকল্প শুরু করার পথেও অগ্রসর হয়।
বেতন কেমন হতে পারে?
পলিটেকনিক পাশ করার পর চাকরির শুরুতে বেতন সাধারণত প্রতি মাসে ১০,০০০ টাকা থেকে ২৫,০০০ টাকা পর্যন্ত হতে পারে। সরকারি চাকরিতে নির্দিষ্ট বেতন কাঠামো অনুযায়ী বেতন হয়। অভিজ্ঞতা ও দক্ষতার সাথে সাথে বেসরকারি ক্ষেত্রে বেতন ৫০,০০০ থেকে ১ লক্ষ টাকা বা তারও বেশি হতে পারে।
কেন পলিটেকনিক পড়বেন? (সুবিধা)
- দ্রুত কর্মসংস্থান: B.Tech কোর্সের তুলনায় কম সময়ে কোর্স শেষ করে চাকরিতে প্রবেশ করা যায়।
- ব্যবহারিক জ্ঞানের উপর জোর: থিওরির পাশাপাশি প্র্যাকটিক্যাল ক্লাসের উপর অধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়, যা কর্মক্ষেত্রে সহায়ক হয়।
- তুলনামূলক কম খরচ: ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রি কোর্সের থেকে পলিটেকনিক কোর্সের খরচ সাধারণত কম।
- উচ্চশিক্ষার সুযোগ: ডিপ্লোমা করার পর B.Tech করার বিকল্প খোলা থাকে।
- শিল্পক্ষেত্রের চাহিদা: দক্ষ ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারদের চাহিদা সবসময়ই থাকে।
কিছু অসুবিধা
- এটি একটি ডিপ্লোমা কোর্স, ডিগ্রি নয়।
- কিছু ক্ষেত্রে B.Tech ডিগ্রিধারীদের তুলনায় কম গুরুত্ব বা সুযোগ পাওয়ার সম্ভাবনা থাকতে পারে, যদিও অভিজ্ঞতা বাড়ার সাথে সাথে এই পার্থক্য কমে আসে।
- গবেষণামূলক কাজের সুযোগ সীমিত।
পশ্চিমবঙ্গের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য পলিটেকনিক কলেজ
সরকারি:
- আচার্য্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় পলিটেকনিক, যাদবপুর
- সেন্ট্রাল ক্যালকাটা পলিটেকনিক, কলকাতা
- কে. জি. ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউট, বিষ্ণুপুর
- পশ্চিমবঙ্গ পলিটেকনিক, কলকাতা
- বিরলা ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি (সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত), কলকাতা
- শিলিগুড়ি গভর্নমেন্ট পলিটেকনিক, শিলিগুড়ি
বেসরকারি:
- জেআইএস স্কুল অফ পলিটেকনিক, কল্যাণী
- টেকনো ইন্ডিয়া পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট (বিভিন্ন স্থানে)
- কিংস্টন পলিটেকনিক কলেজ, বারাসাত
- স্বামী বিবেকানন্দ ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি, কলকাতা
- আরসিসিআইটি পলিটেকনিক (রিজিওনাল কম্পিউটার সেন্টার, কলকাতা)
(দ্রষ্টব্য: কলেজের তালিকা উদাহরণস্বরূপ এবং সম্পূর্ণ নয়। ভর্তির আগে সাম্প্রতিকতম অনুমোদিত কলেজের তালিকা WBSCVT&VE&SD ওয়েবসাইট থেকে দেখে নেওয়া উচিত।)
শেষ কথা
যারা মাধ্যমিক বা উচ্চ মাধ্যমিকের পর দ্রুত একটি সম্মানজনক ও প্রযুক্তিগত পেশায় নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে চায়, তাদের জন্য পলিটেকনিক একটি অত্যন্ত ভালো বিকল্প। সঠিক পরিকল্পনা, কঠোর পরিশ্রম এবং শেখার আগ্রহ থাকলে পলিটেকনিক কোর্স একজন ছাত্র বা ছাত্রীর কেরিয়ারকে এক নতুন দিশা দেখাতে পারে।